বাগদাদে ইবনুল জাওজি (র.) যখন ওয়াজ করতেন, তখন তাঁর সমতুল্য আলেম আর কেউ ছিল না। এজন্য প্রায়ই তাঁর প্রতিপক্ষ ও হিংসুকরা তাঁকে নানা ধরনের প্রশ্ন করত, যাতে জবাব দিয়ে তিনি কোন ভাবে ফেঁসে না যান অথবা তাঁকে বেকায়দায় ফেলা যায়। একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, 'কে উত্তম? আবু বকর রা. নাকি আলি রা.?' তিনি দ্রুততার সাথে জবাব দিলেন, 'যার অধীনে তাঁর মেয়ে আছে, সেই উত্তম।' একথা বলেই তিনি দ্রুত মিম্বর থেকে নেমে আসলেন। ফলে প্রশ্নকর্তা আর তাঁর উত্তরের ব্যাখ্যা জানার সুযোগ পেল না।
উপস্থিত লোকদের মধ্যে যারা আবু বকর রা. কে শ্রেষ্ঠ মনে করত, তারা বলল, আবু বকরই সর্বশ্রেষ্ঠ। কারণ তাঁর মেয়ে আইশা রা. কে তিনি মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বিয়ে দিয়েছিলেন। আইশা রা. স্বাভাবিকভাবেই পিতার অধীন।
অন্যপক্ষের লোকেরা ভাবল এখানে আলি (রা.) এর কথা বলা হচ্ছে। কারণ মহানবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কন্যা ফাতিমা (রা.) কে আলি (রা.) এর সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। তাই ফাতিমা (রা.) ও তাঁর স্বামীর অধীন।
ইবনুল জাওজি (র.) খুব দ্রুততার সাথে মোক্ষম জবাব দিতে পারতেন। ইয়াযিদকে লানত দেয়া নিয়েও এভাবে ইবনুল জাওজি (র.) কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি জবাবে বলেছিলেন, 'চুপ থাকাই উত্তম।' প্রশ্নকর্তা বলেছিল, 'চুপ থাকা ভালো, তা তো জানিই। তাকে লানত দেয়া জায়েয হবে কি না, সেটাই জানতে চাচ্ছি।'
তখন ইবনুল জাওজি জবাব দিলেন, 'সেই লোককে নিয়ে তোমরা কী বল, যে মাত্র তিন বছর ক্ষমতায় ছিল। প্রথম বছর সে হুসাইন (রা.) কে হত্যা করেছে। দ্বিতীয় বছর মদিনাবাসীকে ভীত-সন্ত্রস্ত করেছে এবং মদিনাকে তিনদিনের জন্য বৈধ ঘোষণা করেছে। সর্বশেষ বছর কাবাঘরে গোলা মেরে কাবাঘর ধ্বংস করেছে।' তারা বলল, 'তাহলে লানত দেব।' তিনি বললেন, 'হ্যাঁ। লানত দেবে।'তখন ইবনুল জাওজি (র.) বাগদাদের মজলিসের মিম্বরে বসে খলিফা আন নাসির লি দিনিল্লাহ (১১৮০ খ্রি.-১২২৫ খ্রি.) এবং বিশিষ্ট আলিমগণের সামনে সরাসরি ইয়াযিদকে লানত দিলেন। যারা এ মতের সমর্থক ছিল না, তারা মজলিস ছেড়ে উঠে চলে গেল। তারা তখন তিলাওয়াত করছিল,
اَلَا بُعۡدًا لِّمَدۡیَنَ کَمَا بَعِدَتۡ ثَمُوۡدُ
জেনে রাখো, ধ্বংসই ছিল মাদাইয়ানবাসীর পরিণাম, যেভাবে ধ্বংস হয়েছিল সামুদ সম্প্রদায়।' (আল কুরআনুল কারিম, ১১: ৯৫)
এ ঘটনা শুনে ইবনুল জাওজি (র,) কে রদ করার জন্য আব্দুল মুগিস হাম্বলি তৎপর হয়ে উঠল। সে 'ফাদাইলু ইয়াজিদ' বা 'ইয়াজিদের মর্যাদা' নামে আশ্চর্য একটি গ্রন্থ লিখল। এ বই দেখে ইবনুল জাওযি নিজেই আব্দুল মুগিসের এ গ্রন্থ খণ্ডন করে 'আর রাদ্দু আলাল মুতাআসসিবিল আনিদিল মানি মিন যাম্মি ইয়াজিদ' নামের এ বইটি লিখলেন।
যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় "ইয়াজিদকে নিন্দা করার বৈধতা ও বিরুদ্ধবাদীদের যুক্তিখণ্ডন"
।
ইমাম ইবনুল জাওজির এ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি বাগদাদের মাকতাবাতুল আওকাফে সংরক্ষিত আছে। ইবনুল জাওজি (র.) যে এ বইটি রচনা করেছিলেন, তা অসংখ্য জীবনীকারের বক্তব্যে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। সিবত ইবনুল জাওযি তাযকিরাতুল খাওয়াস গ্রন্থে, ইবনুল আসির আল কামিল গ্রন্থে, ইবন কাসির আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে, ইবন তায়মিয়া মিনহাজুস সুন্নাহ গ্রন্থে, ইবন রজব হাম্বলি আয যাইল আলা তাবাকাতিল হানাবিলা গ্রন্থে, ইমাম যাহাবি সিয়ারু আলামিন নুবালা গ্রন্থে, ইবন হাজার হায়তামি আস সাওয়াইকুল মুহরিকা গ্রন্থে, হাজি খলিফা কাশফুয যুনুন গ্রন্থে, ইসমাঈল পাশা হাদিয়াতুল আরিফিন গ্রন্থে এ বইয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। এঁদের মধ্যে ইবনুল আসির, ইবন কাসির, ইবন তায়মিয়া, যাহাবি প্রমুখ সরাসরি বইয়ের নাম উল্লেখ না করলেও এটুকু ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ইমাম ইবনুল জাওজি (র.) ইয়াযিদকে লানত দেয়ার বৈধতা নিয়ে স্বতন্ত্র গ্রন্থরচনা করেছেন। অন্যরা সবাই বইয়ের নাম উল্লেখ করেছেন।
বইটির PDF দেখুন